মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

সেজদা

যাবতীয় প্রসংশা আল্লাহ তা’আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। দৃশ্য-অদৃশ্য যা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে সব আল্লাহরই সৃষ্টি। তিনি ছাড়া সবই তাঁর সৃষ্ট। আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় । তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাকেও জন্ম দেননি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। তাঁর অনুরূপ কোন কিছুই হতে পারে না। তিনি অনাদি অনন্ত। সব কিছুর পূর্ব হতেই তিনি আছেন এবং থাকবেন। তাঁর শেষ নেই। তাঁর অনুরূপ কোন কিছুই হতে পারে না। তিনি বড় এবং সবকিছু থেকে পৃথক। তিনি সর্ব শ্রোতা এবং সর্বজ্ঞানী। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কিছুই নেই। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন, তাতে কারো বাধ সাধার সাধ্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব। সব কিছুর উপরই তিনি ক্ষমতাবান। সকলের উপর তারই আধিপত্য। তাঁর উপর অন্যের কোন আধিপত্য নেই। তিনি রাজাধিরাজ। তিনি সম্পূর্ণ দোষত্রুটি মুক্ত। তাঁর যাবতীয় গুণ অনন্তকাল ধরে আছে এবং থাকবে। তিনি পরাক্রমশালী। তিনিই সকলের রিযিক দাতা। তিনি না নিদ্রা যান, আর না তন্দ্রা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে। জগতে যা কিছু সংঘটিত হয় সমস্ত তাঁরই নির্দেশে এবং তাঁরই কুদরতে সংঘটিত হয়। নিখিল জাহান তিনিই রক্ষণাবেক্ষণ করেন, এতে তাঁর কোন ক্লান্তি নেই। কোন শরীক নেই তাঁর। এবাদতের যোগ্য একমাত্র তিনিই। আল্লাহ ছাড়া আর কারও এবাদত করা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া আর কেহ বা কোন কিছুই উপাস্য নেই।

এবাদতের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাহ্যিক স্বরূপ হচ্ছে সিজদা। এবাদতের একমাত্র যোগ্য আল্লাহ তা’আলা। তাই আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও সিজদা করা যাবে না। তাই, কোন মানুষকে সিজদা করা হারাম এবং শিরক। কোন পীর-বুযুর্গকেও সিজদা করা যাবে না। যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার অবকাশ থাকত, তাহলে নারীদের উপর তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করার হুকুম হত। এই প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এর রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, রসূল আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ যদি আমি কোন মানুষকে অন্য কোন সৃষ্ট জীবকে সিজদা করার হুকুম করতাম তাহলে নারীদেরকে আদেশ করতাম যেন তারা নিজ নিজ স্বামীগণকে সিজদা করে (তিরমিযি)।

ইমাম আহমদ এই বিষয়ের একটি হাদীস মাসনাদ নামক কিতাবে হযরত আনাস হতে নিন্মলিখিত ভাবে বর্ণনা করেনঃ কোন মানুষের জন্য অন্য মানবকে সিজদা করা জায়েয নেই। যদি তা জায়েয হোত তাহলে আমি নারীদেরকে আদেশ দিতাম তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করতে। কেননা তার উপর তার স্বামীর অনেক দাবী রয়েছে।

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) একবার শাম দেশে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে হাজির হয়ে তাঁকে সিজদা করলেন। রসূলে আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশ্চার্যের সাথে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘মা হাজা ইয়া মুয়ায?’ অর্থাৎ হে মুয়ায! এটা কি করছ? তিনি বললেন, আমি শাম দেশে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম লোকজন তাদের ধর্মীয় ইমামগণকে, আলেমগণকে, দলীয় নেতাগণকে সিজদা করে। তাই আমার দেলে আসছে আমরাও আপনাকে সিজদা করি। নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ এমনটি করবে না। অতঃপর ইরশাদ ফরমানঃ আমি যদি কাকেও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মাখলুককে সিজদা করার হুকুম দিতাম তবে নারীদেরকে আদেশ করতাম তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করার জন্য (ইবনে মাযাহ)।

হযরত কায়েস ইবনে সায়াদ (রাঃ) তাঁর নিজের একটি ঘটনা এরূপ বর্ণনা করেন। আমি হীরা (কুফার নিকটবর্তী একটি পুরাতন শহর) নামক স্থানে গিয়াছিলাম। আমি সেখানের লোকজনকে তাদের নেতাগণকে সন্মান করার উদ্দেশ্যে সিজদা করতে দেখলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদা পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। অতএব, তাঁকে সিজদা করতে হবে। পরে যখন আমি সফর হতে ফিরে নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে হাজির হলাম তখন এই কথাই আরয করলাম। রসূলে আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ ফরমানঃ বল আমার মৃত্যুর পর তুমি আমার কবরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় আমার কবরকে সিজদা করবে? আমি (হযরত কায়েস) আরয কলাম, আপনার কবরকে সিজদা করব না। তখন তিনি বললেন, এখনও এটি করবে না। অতঃপর তিনি ইরশাদ ফরমানঃ আমি যদি কাকেও আদেশ দিতাম (আল্লাহ ছাড়া) অন্য কোন সৃষ্ট জীবকে সিজদা করার জন্য তবে নারীদেরকে আদেশ দিতাম তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করতে, স্বামীদের ঐ হকের কারণে যা আল্লাহ তা’আয়ালা স্ত্রীগণের উপর নির্ধারিত করেছেন (আবু দাউদ)।

মাসনাদে আহমদের মধ্যে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। একদা একটি উট রসূল আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সিজদা করল। (অর্থাৎ হুযুর সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মুখে উটটি এমনভাবে ঝুকল দর্শকগণ বুঝতে পারল যেন উট সিজদা করছে)। এটা দর্শনে কোন কোন সাহাবা আরয করলেনঃ ইহা রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! উটের ন্যায় চতুষ্পদ জন্তু এবং বৃক্ষ আপনাকে সিজদা করে (অর্থাৎ ঝুকে পড়ে)। তাদের তুলনায় আমাদের কর্তব্য অনেক বেশী আপনাকে সিজদা করা। এই কথার উত্তরে তিনি ইরশাদ ফরমানঃ আপন প্রভুর ইবাদত কর এবং আপন ভাইকে সন্মান কর। যদি আমি আদেশ করতাম অন্য কোন সৃষ্ট জীবকে সিজদা করতে, তবে নারীদেরকে আদেশ দিতাম নিজেদের স্বামীদেরকে সিজদা করতে।

এই সমস্ত হাদীস ও বর্ণনা হতে ইহা স্পষ্ট যে, সিজদা কেবল আল্লাহ তা’আলার জন্যই; অন্য কোন মানুষ বা সৃষ্ট জীব বা বস্তুকে সিজদা করা হারাম এবং শিরক। কারণ ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহই এবং তাঁর কোন শরীক নেই।

মুহাম্মদী শরীয়তে সিজদা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কাহারও জন্য এমনকি সৃষ্ট জীবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সকল আম্বিয়াদের সর্দার হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও সিজদা করার অবকাশ নেই। বর্ণিত হাদীসসমূহে হযরত মুয়ায, হযরর কায়েস এবং অন্যান্য সাহাবাগণ (রাঃ) রসূলে আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যে সিজদা সম্বন্ধে আরয করেছিলেন তা সন্মানসূচক সিজদা সম্পর্কিত ছিল, ইবাদতের সিজদা ছিল না। কারণ, সাহাবা আযমাইনগণ (রাঃ) ইবাদতের সিজদা করার জন্য আরয করবেন তা অসম্ভব। যে ব্যক্তি আল্লাহর একাত্ববাদের দাওয়াতকে স্বীকার করেছে এবং আল্লাহ ও রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান এনেছে তার এ কল্পনাও আসতে পারে না যে, আল্লাহ জাল্লাশানুহু ব্যতীত কোন মানুষ বা সৃষ্ট জীবকে বা বস্তুকে ইবাদতের নিয়তে সিজদা করবে। এই জন্য এটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, হাদীসে উল্লিখিত সিজদা সন্মানের সিজদা সম্পর্কীত প্রশ্ন ছিল। এই জন্যই ফকিহবিদ্গণ কোন মাখলুকের সন্মানে সিজদা করাকে হারাম বলেছেন।

অতএব, যে সমস্ত অজ্ঞ মানুষ তথাকথিত কোন পীর, বুযুর্গ, দরবেশকে বা তাদের মৃত্যুর পর তাদের মাযারকে সিজদা করে থাকে তারা শরীয়তের বিধানে কঠিন অপরাধী। তাদের এই কর্ম নিঃসন্দেহে শিরক যা আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমার অযোগ্য। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনুল করীমে ইরশাদ করেনঃ ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে’ (সুরা আন্‌-নিসা, আয়াতঃ ৪৮)। তফসীরে মাআরেফুল কোরআনে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ইবাদতে শরীক সাব্যস্ত হচ্ছেঃ কাউকে সেজদা করা, কারো নামে কোন পশু মুক্ত করা, কারো নামে মানত করা, কারো কবর কিংবা বাড়ি-ঘরের তওয়াফ করা, আল্লাহ তা’আলার কোন হুকুমের তুলনায় অপর কারো কথা কিংবা কোন প্রথাকে প্রধান্য দেয়া, কারো সামনে রুকু করার মত অবনত হওয়া, কারো নামে জীব কোরবানী করা, পার্থিব কাজ-কারবার কিংবা বিবর্তনকে নক্ষত্রের প্রভাব বলে বিশ্বাস করা এবং কোন কোন মাসকে অশুভ মনে করা প্রভৃতি।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কুফর ও শিরক পরিত্যাগ করে আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন এবং আম্বিয়াকেরামকে মানার ওয়াদা করে ঈমান পাকা করার তৌফিক দিন। মনে রাখতে হবে, যে ব্যক্তি শিরক নিয়ে মৃত্যু বরণ করবে সে জান্নাতে যাবে না। আসমান যমীন সমান গুনাহ করেও যদি কেউ মারা যায় এবং শিরকের জন্য অপরাধী না হয়, তাহলেও আল্লাহর মেহেরবাণীতে সে কোন না কোন সময় বেহেশতে প্রবেশ করবে। কিন্তু শিরক আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে মানুষ বা অন্য কিছুকে সিজদা করা থেকে বিরত রেখে শিরক মুক্ত জীবন যাপনের তৌফিক দান করুন। ওয়ামা তৌফিকই ইল্লাহ বিল্লাহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন