মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

জাত??/

মানুষের জাত কি? মানুষ কোন জাতীয় প্রাণী? সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কোন জাতে সৃষ্টি করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর কে শুধতে পারবেন? জাতে মানুষ বিচার হয় নাকি কর্মে? জন্মে মানুষ বিচার হয় নাকি কর্মে? মানুষ আসলেই কোন জাতের প্রাণী? পৃথিবীর চার হাজার কোটি বয়সে কোন কোন জাতে সে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে? কোন জাতের গর্ব গরিমা এখন পৃথিবীর বুকে লেখা আছে? কে শুধতে পারবেন এই প্রশ্নগুলো। জানি অবান্তার প্রশ্নের কোন উত্তর হয়না। তবুও এই অবান্তার বিষয়গুলোই দেশ, জাতি, সমাজ তথা মানুষের মধ্যে বিশাল ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে যুগের পর যুগ। মানুষের মধ্যে মানুষের সম্পর্কের বিশাল ফারাক তৈরী করেছে এই অবান্তার বিষয়গুলোই। মানুষের মূল্যবোধ এতটাই প্রখর হয়েছে এই অবান্তার বিষয়ে যে, এক জাতের মানুষ আরেক জাতকে দেখলে, উঁচু জাত নিচু জাতকে দেখলে নাক ছেটকোয়, থুথু দেয়। কেউ কেউ আবার এদের কে মানুষই মনে করেন না। কিন্তু সকলের সংঘবদ্ধ মিলনেই পরিবার, সমাজ, দেশ তথা পৃথিবী। সব জাতের মানুষ আছে বলেই পৃথিবীর ভারসাম্যতা বজায় রয়েছে।
জাতের নামে যেভাবে বজ্জাতি বেড়েছে তাতে করে জাত রসায়ন একটা বিষয় আজকালের ছেলে মেয়েদের না শেখালেই নয়। কারণ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার মাঝেই এই রসায়নটা কম বেশি আছে। কেউ আবার একেবারেই গোঁড়া। আবার কেউ এসবের ধার ধারেন না। জাত না বাছলে কারও জীবন থাকেনা, কেউ আবার এসবের কোন তোয়াক্কাই করেন না। পৃথিবীতে হাজার রকম মানুষ আছে। তাদের চিন্তা ভাবনাও হাজার রকম। কারণ পৃথিবীর একেকজন মানুষ একেকটা বিষয়কে একেকভাবে মূল্যায়ন করে, একেকজন একেকটা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে। তাই তাদের কাছে একেকটা জিনিসের সংজ্ঞাও একেক রকম। কারণ তাদের চিন্তাভাবনার তারতম্য, তাদের পরিবেশের ভিন্নতা, তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ভিন্ন।
তাহলে, জাত কত প্রকার? জাতের প্রকার ভেদ অনেক দৃষ্টিকোন থেকে করা যায়। একেক শ্রেণী বিভাজনে জাত একেক রকম। জাতের শেণীবিভাগ মূলত ৯ ভাবে করা যায়। ১/ দেশ বা রাষ্ট্র ভিত্তিক, ২/ জেলা ভিত্তিক, ৩/ গোষ্টি বা বংশ ভিত্তিক, ৪/ অঞ্চল বা অবস্থান ভিত্তিক, ৫/ ধর্ম ভিত্তিক, ৬/ কর্ম ভিত্তিক, ৭/ উপজাতিক, ৮/ নেতীবাচক ভিত্তিক, ৯/ অবস্থা ভিত্তিক। দেশ ভিত্তিক বা রাষ্ট্র ভিত্তিক জাত ২৩৩ প্রকার। পৃথিবীতে রাষ্ট্র ২৩৩টি। সেই দৃষ্টিকোন থেকে জাত ২৩৩ প্রকার। যেমন: চাইনিজ, জাপানিজ, ফ্রান্সিস, স্পেনিস, সুইডিস, ইন্ডিয়ান, শ্রীলংঙ্কান, আমেরিকান, ইতালিয়ান, কোরিয়ান, রোমান, জার্মান, আফ্রিকান, লিবিয়ান, আফগান, ইরানী, পাকিস্থানী, বাংলাদেশী ও ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশ হিসেব জেলা ভিত্তিক জাত ৬৪ প্রকার। কারণ বাংলাদেশে ৬৪ জেলায় ৬৪ রকমের মানুষ বাস করে। তাদের কৃষ্টিকালচার একেক রকম। তারা ভাষাগত এবং আচার আরণের দিক থেকে ভিন্ন। যেমন: ঢাকাইয়া, নোয়াখাইল্লা, বরিশাইল্লা, চিটাগাইঙ্গা, জামালপুইরা, গোপালী, সিলেটি ইত্যাদি। গোষ্টি ভিত্তিক জাত মানে একেক জনের জন্ম একেক পরিবারে, একেক গোষ্টিতে। যেমন কারও জন্ম চৌধুরী বংশে, কারও আবার পাটোয়ারী বংশে। এরা একেক জন সতন্ত্র ও আলাদা এবং এদেও মধ্যে কেউ আশরাফ কেউ আতরাফ। সে হিসেবে বাংলাদেশে অনেক বংশ রয়েছে। যেমন: চৌধুরি, পাটোয়ারী, বেপারি, মির্জা, মৃথা, প্রধান, খান, গাজী, মুন্সি, হাওলাদার, ইত্যাদি। অঞ্চল ভিত্তিক জাত মানে একেক জনের একেক অঞ্চলে জন্ম হয়েছে, তাদেও জন্মেও ভিত্তিতে যে বিভাজন করা হয়। যেমন কারও জন্ম অজপাড়া গ্রামে এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা তারা হলো গ্রাম্য ক্ষেত। আবার যাদেও জন্ম চর অঞ্চলে তারা আবার চৌরা, যাদের জন্ম ও জীবন-যাপন নৌকায় নৌকায় তারা হলো বেদে। অঞ্চল ভিত্তিক এদের জীবন যাপনের ভিন্নতার কারণে এদেরকে বিভাজিত করা হয়। এদেশে প্রধানত ধর্ম ভিত্তিক চারটি জাত। যেমন: মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। কর্ম ভিত্তিক জাত মানে যাদেরকে কর্মের মাধ্যমে বিচার কার হয়। যেমন কৃষক কৃষি কাজ করে, মেথর ময়লা পরিষ্কার করে, নাপিত চুল কাটে। এরা একেক জন পেশার দিক থেকে একেকটা জাতে বাস করে। বাংলাদেশে কর্ম ভিত্তিক জাত অনেক প্রকার। যেমন: কৃষক, নাপিত, মেথর, কামার, কুমার, ধোপা, ডাক্তার, উকিল, ব্যবসায়ী ইত্যাদি। উপজাতি মানে যারা জন্মগতভাবে আমাদের দেশীয় নয় কিন্তু বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাস করে। আমাদের দেশে প্রায় পনেরটির বেশি উপজাতি রয়েছে। যেমন: চাকমা, মারমা, সাওতাল, মং, মুরং, গারো ইত্যাদি। নেতিবাচক ভিত্তিতে জাত তিন প্রকার। যেমন: অজাত, বিজাত, কুজাত। অবস্থার ভিত্তিতে জাত তিন প্রকার, যেমন: উঁচু জাত, নিচু জাত, মধ্যম জাত।
আসলে কি মানুষের উপর জাত বড় নাকি জাতের উপর মানুষ? পৃথিবীতে মানুষ আগে এসেছে নাকি জাত? কোনটার প্রাধান্য বেশি, আর কোনটার মূল্যায়ণ বেশি হওয়া উচিত। সে বিচারের ধার কেই বা ধারে। কেউ জাত ভারে নতজান, কেউ জাতের গর্বে গরিয়সী। সৃষ্টিকর্তার কাছে মানুষের কোন কোন জাত বিভাজন নেই। যা আছে তা শুধু কতিপয় এই মানুষের কাছে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার কাবতায় লিখেছিলেন, ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে/ সে জাতির নাম মানব জাতি।’ পৃথিবীতে একটাই জাতি, পৃথিবীতে মানুষের উপর কোন জাত নেই, মানুষের কোন বিভাজন নেই। কবিতায় কবি আরও লিখেছিলেন, ‘বাহিরেতে কেবল কালো আর ধলো/ ভীতরে সবার সমান রাঙা।’ আমাদের বাহিরের রূপ যার যেটাই হোক না কেন দেহের ভীতরে সবারই রক্তই লাল। সেখানেও তো কোন জাতের ভীন্নতা নেই। এক সময় ছিল যখন মুসলমানের ছোঁয়া লাগলে হিন্দুর জাত যেতো। তারপর গঙ্গা স্নান করে জাতে ফিরতে হতো। আবার কোন হিন্দুর মুখ দেখলে মুসলমানের অজু নষ্ট হয়ে যেতো। মানুষ এতটা গোড়া অবস্থান থেকে এখন বেরিয়ে এসেছে তবে পুরোপুরি মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখেনি। মানুষকে ভালবাসার মাধ্যমেই ¯স্রষ্টার সাক্ষাত মিলে। এ কথাকে যারা প্রাণে যারা বিশ্বাস করেছিলেন তারাই মানুষের কল্যানে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। দামিয়ানের গল্প অনেকেই জানেন হয়তো। কুষ্ট রোগিদের সেবা করতে করতে সে নিজেই যেদিন কুষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, সেদিনই সে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল। দ্বীপের সকল কুষ্ট রোগীদের ডেকে দামিয়ান বলেছিল, ‘আজ আমি সবচেয়ে খুশি, কারণ এতো দিন আপনাদের সাথে আমার পার্থক্য ছিল, কিন্তু আজ হতে আমিও আপনাদের মতো। আজ হতে আমার আর কোন ভয় নেই, আমি আরও বেশি করে আপনাদের সেবা করতে পারব।’ এরা মানুষের মধ্যে ¯স্রষ্টার প্রতিচ্ছিবি দেখেছেন তাই তারা মানুষকে এত কাছে টেনেছেন। ইতালি শহরের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মানব সেবায় সারাটা জীবন উৎস্বর্গ করেছেন। তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো, আপনি ধনী পরিবারের মেয়ে হয়ে নার্সের মত নি¤œমানের পেশা কেন বেছেনিলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ে অনেকেই ডাক্তার হতে চায় কিন্তু নার্স কেউ হতে চায়না। একজন ডাক্তার রোগীকে যতটুকু সেবা দিতে পারে তার চেয়ে একজন নার্স বেশি সেবা দিতে পারে। তাই আমি নার্স পেশা বেছে নিয়েছে।’ নাইটিঙ্গেলকে বলা হয় ‘দ্বীপ হাতে রমণী’ কারণ তিনি গভীর রাতে প্রদীপ নিয়ে অসুস্থ রোগীদের দেখতেন, কে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, কে এখন নির্ঘুম। অতঃপর রোগীদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। এভাবে করে একের পর এক সব রোগিদের ঘুরে-ঘুরে দেখতেন। মাদার তেরেসা, হেলেন কেলারের মত অনেক মহিয়ান, মাহিয়সী মানুষ আছেন যারা কেবলমাত্র মানুষকে ভালবেসেই জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন।
ছেলের মুখে মুখে থুতু দিয়ে মাকে ধুপধূনো দিলে মা যেমন খুশি হন না ঠিক তেমনি মানুষকে ঘৃণা করে স্রষ্টার উপাসনা করলে স্রষ্টাও খুশি হন না। মানুষের কল্যান সাধনের মধ্য দিয়েই স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জন করা যায়। মানুষের কোন জাত নেই। মানুষের কোন জাত হয়না। মানুষ তো মানুষই। এই বোধ যাদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, তারাই কেবল মানুষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন